লাশ উদ্ধারের আগের দিন (১২ জুলাই) দুপুরে সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম রঞ্জুকে এক লাইনের একটি এসএমএস পাঠিয়েছিলেন সাংবাদিক সোহানা তুলি। তাতে লেখা ছিল ‘আজকে তুই মরার খবর পাবি’।
এরপরও রফিকুল ইসলাম রঞ্জু তুলিকে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে ফেরাতে কোনও উদ্যোগ নেননি। সাংবাদিক সোহানা তুলির সহকর্মী ও বন্ধুরা বলছেন, ‘এই বার্তা পাওয়ার পর রঞ্জু উদ্যোগ নিলে তুলি হয়তো আত্মহত্যা করতো না। তাকে এই সিদ্ধান্ত থেকে ফিরিয়ে আনা যেতো।’
আত্মহত্যার কথা বলে ক্ষুদে বার্তা পাঠানোর আগে তুলি রঞ্জুকে ফোনও করেছিলেন। কিন্তু রঞ্জু ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি ফিরতি কলও করেননি। এ কারণেই ক্ষোভে তুলি আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোক্তারুজ্জামান জানান, তারা সবগুলো বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। তুলির মৃত্যুর পেছনে যদি কারও প্ররোচনা বা সম্পৃক্ততা থাকে তবে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।
গত বুধবার (১৩ জুলাই) দুপুরে রায়েরবাজারের মিতালীর রোডের বাসা থেকে সাংবাদিক সোহানা পারভীন তুলির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তুলিকে ফোনে না পেয়ে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নন্দিতা তার বাসায় গিয়ে দরজায় নক করেন।
সাড়া না পেয়ে নিরাপত্তারক্ষীর সহায়তায় দরজা ভেঙে তুলিকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান তারা। বিষয়টি হাজারীবাগ থানা পুলিশকে জানালে পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়।
সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহের পর তুলির মরদেহ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। একদিন পরে ময়নাতদন্ত শেষে তার মরদেহ যশোরের গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।
সাংবাদিক সোহান তুলির ভাই মোহাইমেনুল ইসলাম বলেন, ‘আপুর (সোহানা তুলি) মৃত্যুর পেছনে যার প্ররোচনা রয়েছে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। আপুর আত্মহত্যা করার মানসিকতা কখনোই ছিল না। এমন কিছু ঘটেছে যা তাকে আত্মহত্যায় ধাবিত করেছে। আমরা চাই পুলিশ সত্য উদ্ঘাটন করে দায়ী ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনুক।’
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সাংবাদিক সোহানা তুলির লাশ উদ্ধারের পর প্রাথমিক আলামত বিশ্লেষণ করে আত্মহত্যার ঘটনা মনে হয়েছে। এরপরও ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা রিপোর্টের পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, তদন্তে সাংবাদিক সোহানা তুলির সঙ্গে রফিকুল ইসলাম রঞ্জু নামের একজনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের তথ্য পাওয়া যায়। পরে রঞ্জুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
রঞ্জুও তুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা স্বীকার করেছেন। এমনকি লাশ উদ্ধারের একদিন আগে তুলির বাসায় যাওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন তিনি।
তবে আগের দিন তাদের মধ্যে কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল সে বিষয়ে রঞ্জু কিছু বলেননি। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। এমনকি আত্মহত্যার কথা লিখে তুলি যে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, তা না পড়েই ডিলিট করার কথা জানিয়েছেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, লাশ উদ্ধারের আগের দিন বিকাল ৩টা ৯ মিনিটে তুলির মোবাইল থেকে রঞ্জুর মোবাইলে ওই এসএমএস পাঠানো হয়। এক লাইনের বার্তাটি ডিলিট করতে গেলেও তা চোখে পড়ার কথা।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে রঞ্জু এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, তিনি বার্তাটি না পড়েই ডিলিট করেছেন।
তুলি যে বাসায় থাকতেন সেই বাসার নিরাপত্তাকর্মী আজিমুদ্দিন জানান, বছর তিনেক ধরে তুলি ওই বাসার দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। রঞ্জু নামের ওই ব্যক্তি প্রতি সপ্তাহেই বন্ধু পরিচয় দিয়ে তুলির বাসায় যাতায়াত করতো। মালিকের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি রঞ্জুর মোটরসাইকেলের নম্বর লিখে রেখেছিলেন। তার দেওয়া নম্বরের সূত্র ধরেই রঞ্জুকে শনাক্ত করে পুলিশ।
এদিকে একটি জাতীয় দৈনিকে যুগ্ন সম্পাদক পদে কর্মরত রফিকুল ইসলাম রঞ্জুকে এই ঘটনার পর সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। কুড়িগ্রামের বাসিন্দা রঞ্জু স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে মিরপুরের একটি বাসায় থাকেন। বছর দশেক আগে আরেকটি জাতীয় দৈনিকের বার্তা বিভাগে কাজ করতে গিয়ে তুলির সঙ্গে রঞ্জুর পরিচয় হয়েছিল বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদকিতা বিভাগের ২০০২-০৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন সোহানা তুলি। তিনি দৈনিক আমাদের সময়, দৈনিক কালের কণ্ঠে কাজ করেছেন। সর্বশেষ ২০২১ সালের মে পর্যন্ত বাংলা ট্রিবিউনে কর্মরত ছিলেন। এরপর কিছু দিন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেনে। সম্প্রতি একটি অনলাইন শপ খুলে নারী উদ্যোক্তা হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তিনি।