ব্যাসেল-৩ এর শর্ত পূরণে এবং মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকারের কাছে ৬ হাজার কোটি টাকার ‘ব্যাংক গ্যারান্টি’ চেয়েছে সোনালী ব্যাংক। নানা অনিয়ম, ঋণ খেলাপিসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাংকটি বর্তমানে মূলধন ঘাটতিতে ভূগছে। এ অবস্থায় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ ওবায়েদ উল্ল্যাহ আল মাসুদ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে মূলধন ঘাটতি মেটাতে চিঠি দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সোনালী ব্যাংক সরকারের ট্রেজারি ব্যাংক হিসেবে কাজ করে। এ জন্য জনগণকে বিভিন্ন আর্থিক সেবা দিয়ে থাকে। এর বিনিময়ে ব্যাংকটি তেমন কোন আর্থিক সুবিধা পায় না। ফলে ব্যাংকটিকে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়। এছাড়া মুনাফা থেকেও মূলধন ঘাটতি মেটানো সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় সরকারের কাছে ব্যাংকটি মূলধন বাবদ 'ব্যাংক গ্যারান্টি' চেয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারকে কোনো নগদ অর্থ দিতে হবে না, শুধু কাগজে-কলমে দায়িত্ব নিতে হবে।
সূত্র জানায়, ব্যাসেল-৩-এর একটি প্রভিশন অনুযায়ী মালিক হিসেবে রাষ্ট্র বা সরকার এই ব্যাংককে গ্যারান্টি দিলে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই গ্যারান্টিকে গ্রহণ করলে তা মূলধন হিসেবে গণ্য হবে। সে হিসেবেই নগদ অর্থের পরিবর্তে ৬ হাজার কোটি টাকা ‘ব্যাংক গ্যারান্টি’র আবেদন করেছে সোনালী ব্যাংক।
সোনালী ব্যাংকের এমডি তার চিঠিতে ব্যাংকটির বিভিন্ন সেবার যথাযথ আর্থিক মূল্য নির্ধারণের অনুরোধ জানিয়েছেন। অন্যদিকে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সোনালী ব্যাংকে ৯৪ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়। যেখান থেকে পরিমিত কমিশন বাবদ ব্যাংকের পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু প্রকল্পটি জনস্বার্থে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হওয়ায় সরকার কমিশন বাবদ দুই দফায় ব্যাংকটিকে মাত্র ২০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করে। ফলে ব্যাংটিকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তাই কমিশন বাবদ থোক বরাদ্দ না দিয়ে পরিমিত হারে কমিশন দেওয়ারও অনুরোধ জানানো হয়েছে চিঠিতে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, ২০১৯ সাল শেষে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণ করার কথা সাড়ে ১২ শতাংশ। যদিও ২০১৫ শেষে এ হার ছিল ১০ দশমিক ৬২ শতাংশ। এ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের হার নেমে এসেছে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে।
অবশ্য ২০১৯ সালের শেষে আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় সোনালী ব্যাংকের ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
চিঠিতে বলা হয়েছে, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় বিভিন্ন পর্ষায়ের সুবিধাভোগীকে বিনামূল্যে ৩৭টি সেবা ও নামমাত্র মূল্যে ১৪টি সেবা দেয় ব্যাংকটি। এসব সেবা দিতে ব্যাংককে বিপুল পরিমাণ ব্যয় বহন করতে হয়। বিশেষ করে আর্মি পেনশন, সিভিল পেনশন, সঞ্চয়পত্র ও ওয়েজ আর্নার বন্ডের ক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংক নিজস্ব তহবিল ব্যবহার করে সেবা দেয়। সেবামূল্য পরিশোধের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে পুনর্ভরণ পেতে অনেক সময় লাগে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এবং সরকারি সিদ্বান্তে অনেক অলাভজনক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বিপিসি, বিজেএমসি, বিএডিসি ইত্যাদি সংস্থার সংকটে ১৪ শতাংশ হার সুদে ঋণ দেওয়া হলেও পরে সরকারি সিদ্ধান্তে মাত্র ৫ শতাংশ সুদে ২০ থেকে ৩০ বছর মেয়াদে বন্ড নেওয়ার মাধ্যমে ঋণ সমন্বয় করা হয়। ফলে এসব ক্ষেত্রে ব্যাংকের বছরে এক হাজার ৫৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয়।
২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত সাতটি ব্যাংকসহ মোট ১০টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৬ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। যদিও মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় চলতি বছরের জুন মাসে সোনালী ব্যাংককে ৪০০ কোটি টাকা দিয়েছে। যা সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে যথেষ্ঠ নয় বলে ব্যাংকটি দাবি করেছে।