বিশ্ব রাজনীতির বড় সংকট এখন কেবল ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াই নয়, বরং আস্থার লড়াই। বিশেষ করে জেন-জি প্রজন্মের (১৯৯৭–২০১২ সালে জন্ম নেওয়া তরুণ সমাজ) কাছে আজকের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। এই প্রজন্মের দৃষ্টিতে প্রচলিত রাজনীতি অনেকাংশেই অবিশ্বাস্য, পুরনো, এবং তাদের বাস্তব চাহিদার সঙ্গে অসংগত। তারা প্রযুক্তিনির্ভর, বৈশ্বিক চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত এবং তাৎক্ষণিক স্বচ্ছতা চায়—যা বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে বারবার সংঘর্ষ তৈরি করছে।
জেন-জি: ভিন্ন এক ভোটার শ্রেণি এবং সামাজিক পরিবর্তনের চালিকাশক্তি
জেন-জি প্রজন্মকে প্রায়শই 'ডিজিটাল নেটিভস' বলা হয়, যারা কেবল তথ্য দ্রুত গ্রহণ করে না, বরং যাচাই-বাছাইও করে। তাদের কাছে নেতা বা দলের পরিচয়ের চেয়ে নীতির কার্যকারিতা ও ফলাফল বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
জলবায়ু ও নৈতিক অগ্রাধিকার: পিউ রিসার্চ সেন্টারের (২০২৩) এক জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে জেন-জি ভোটারদের ৭০% জলবায়ু পরিবর্তনকে “অত্যন্ত জরুরি ইস্যু” হিসেবে দেখে, যেখানে পুরোনো প্রজন্মের মাত্র ৩০% একই গুরুত্ব দেয়। এটি প্রমাণ করে, তাদের কাছে ভবিষ্যৎ-কেন্দ্রিক নৈতিক ইস্যুগুলি তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক বা দলীয় আনুগত্যের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আস্থার অভাব: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির একটি সমীক্ষায় (২০২২) তরুণদের অর্ধেকের বেশি বিশ্বাস করে, “রাজনীতিবিদরা জনগণের কথা শোনেন না।” এই অবিশ্বাস কেবল একটি দলের প্রতি নয়, বরং সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি। তারা মনে করে, প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করছে, জনস্বার্থ নয়।
কর্ম বনাম বক্তৃতা: এই প্রজন্ম রাজনৈতিক বক্তৃতার চেয়ে কর্ম ও নীতির কার্যকারিতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, প্রতিশ্রুতি এবং বাস্তবের ফারাক দ্রুত উন্মোচিত হয়, যা তাদের হতাশা আরও বাড়িয়ে তোলে। তারা শুধু ভোটার নন, বরং বাস্তব পরিবর্তনের প্রত্যাশী।
নেতৃত্ব সংকটের মূল কারণ: অস্বচ্ছতা এবং বিশ্ব-বিমুখতা
জেন-জি প্রজন্মের কাছে আজকের নেতৃত্ব সংকটে পড়েছে মূলত চারটি কারণে—যা তাদের ডিজিটাল নৈতিকতা এবং বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
১. কাঠামোগত স্বচ্ছতার অভাব:
জেন-জি এমন এক সমাজে বড় হয়েছে, যেখানে তারা গুগল বা উইকিপিডিয়ার মতো প্ল্যাটফর্মে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তথ্য যাচাই করতে পারে। ফলস্বরূপ, তারা দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং তথ্যের গোপনীয়তাকে সহজেই প্রত্যাখ্যান করে। তারা চায় সরকারের প্রতিটি স্তরে ব্লকচেইন-স্তরের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা।
২. গ্লোবাল ইস্যুতে উদাসীনতা:
তাদের কাছে পরিবেশ, মানবাধিকার, প্রযুক্তি-নিয়ন্ত্রণ, বৈশ্বিক শান্তি ও ন্যায়বিচার—এগুলি বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, বরং একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। যখন প্রচলিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্থানীয় ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তখন জেন-জি তাদের পরিবেশের বিপর্যয়, আন্তর্জাতিক সংঘাত বা প্রযুক্তিগত নীতি প্রশ্নে অস্পষ্ট বা দুর্বল অবস্থান দেখে হতাশ হয়। তারা চায় বৈশ্বিক চিন্তা, লোকাল কর্ম।
৩. ক্যারিশমা বনাম কার্যকারিতা (The Authenticity Gap):
প্রচলিত নেতারা এখনো পুরনো দিনের বক্তৃতা, জনসভা ও ক্যারিশমাকে প্রাধান্য দেন। কিন্তু জেন-জি প্রজন্ম 'ক্যারিশমা'র চেয়ে ‘সত্যতা’ (Authenticity) বেশি মূল্য দেয়। তারা চায় স্পষ্ট নীতি, ডেটা-ভিত্তিক সমাধান এবং যারা নিজেদের ভুল স্বীকার করে। তথ্যের অবাধ প্রবাহের কারণে, মিথ্যা ক্যারিশমা বা লোক দেখানো ভাবমূর্তি তাদের কাছে মুহূর্তেই হাস্যকর ও বিশ্বাসযোগ্যতা-হীন হয়ে পড়ে।
৪. বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক বৈষম্য:
উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পরেও বেকারত্ব এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য এই প্রজন্মকে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আরও সন্দিহান করে তুলেছে। তারা দেখেছে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় চিত্র: আস্থার ভাঙন কোথায় স্পষ্ট?
বিশ্বজুড়ে এই সংকটের প্রতিফলন ঘটছে তরুণদের রাজনৈতিক আচরণে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ: যুক্তরাষ্ট্রে তরুণ ভোটাররা বাইডেন প্রশাসনের জলবায়ু নীতি ও ছাত্রঋণ সংস্কার নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে, যার ফলে নির্বাচনে তাদের উৎসাহ কমতে পারে। ইউরোপে গ্রীটা থুনবার্গের মতো তরুণরা জলবায়ু আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে, যা প্রচলিত দলগুলিকে অস্বস্তিতে ফেলেছে এবং নীতি পরিবর্তনে চাপ সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া: বাংলাদেশে দুর্নীতি, বেকারত্ব, এবং রাজনৈতিক সহিংসতা তরুণদের আস্থাকে ভেঙে দিয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ কমে আসছে, কিন্তু অনলাইন-ভিত্তিক প্রতিবাদ, হ্যাশট্যাগ আন্দোলন বা সামাজিক সচেতনতা প্রচারে তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। এটি প্রমাণ করে, তারা রাজনীতি থেকে সরে যায়নি, বরং তারা রাজনীতির চিরায়ত প্ল্যাটফর্মকে প্রত্যাখ্যান করছে।
ভবিষ্যতের পথ: সম্ভাবনার জানালা
তবুও সংকট মানেই পতন নয়; বরং এটিই রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য একটি সুযোগ এবং একটি বাধ্যতামূলক পরিবর্তনের ডাক। যে নেতৃত্ব এই পরিবর্তনকে গ্রহণ করবে, তারাই ভবিষ্যতের রাজনীতিতে টিকে থাকবে।
তরুণদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ানো: নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তরুণদের জন্য আনুষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। শুধু ভোটের জন্য নয়, বছরব্যাপী নীতি আলোচনায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
প্রযুক্তি ও স্বচ্ছতা: প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আনা (যেমন, অনলাইন বাজেট ট্র্যাকিং, ডিজিটাল অভিযোগ নিষ্পত্তি)। 'ডিজিটাল নেটিভস' প্রজন্মকে বোঝাতে হবে যে সরকারও তাদের মতো 'স্মার্ট' এবং জবাবদিহিমূলক।
দীর্ঘমেয়াদী নীতি: জলবায়ু পরিবর্তন, চাকরির বাজার সংস্কার, এবং প্রযুক্তি-নিয়ন্ত্রণের মতো দীর্ঘমেয়াদী বৈশ্বিক ইস্যুকে দলীয় ইশতেহারের মূল অংশে আনা, কেবল সাময়িক প্রতিশ্রুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখা।
উপসংহার: ভবিষ্যতের নেতা কে?
আমার কাছে বিষয়টি স্পষ্ট—আজকের রাজনীতির সবচেয়ে বড় যুদ্ধ আর ক্ষমতার আসন দখলের নয়; বরং আস্থার আসন দখলের। জেন-জি প্রজন্মের কাছে বিশ্বাসযোগ্য না হলে কোনো নেতৃত্বই দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকবে না। তারা ভবিষ্যতের ভোটার নয়, বর্তমান পরিবর্তনের চালিকাশক্তি।
রাজনীতিবিদরা যদি এই প্রজন্মের চোখে নিজেদের বৈধতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন, তবে বিশ্ব নেতৃত্বে এক অভূতপূর্ব শূন্যতা (Leadership Vacuum) তৈরি হবে, যেখানে প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর জায়গায় অনির্বাচিত কিন্তু প্রভাবশালী অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বা টেক প্ল্যাটফর্মের শক্তি বাড়তে থাকবে। আর যদি তারা এই প্রজন্মকে তাদের সঙ্গী করতে পারে—তাহলে নতুন যুগের রাজনীতি শুরু হবে স্বচ্ছতা, ডেটা এবং নৈতিকতার হাত ধরে।