দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক পাঁচতারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা। মাঝে এটি ঢাকা শেরাটন হোটেল ও রূপসী বাংলা হোটেল নামে কার্যক্রম পরিচালনার পর ৩৫ বছর পর ফের পুরনো নামে ফিরছে। দীর্ঘ প্রায় চার বছরের সংস্কার কাজ শেষে ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা’ সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হোটেলটির দুয়ার উন্মোচন করবেন। ওইদিন থেকেই হোটেলটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হবে বলে সরকারের পক্ষে এই হোটেল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রাপ্ত বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেড (বিএসএল) সূত্রে জানা গেছে।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক পাঁচতারকা হোটেল হিসেবে ১৯৬৬ সালে তার যাত্রা শুরু করে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যায়। পরবর্তীতে স্টারউড কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হওয়ায় ১৯৮৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ঢাকা শেরাটন হোটেল নামে তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর হোটেল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেড (বিএসএল) নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় 'রূপসী বাংলা হোটেল' নামে এটি চালিয়েছে। পরে ২০১৩ সালে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল গ্রæপের (আইএইচজি) সঙ্গে বিএসএলর চুক্তি সম্পাদিত হয়। ওই চুক্তির আওতায় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর হতে সংস্কারের জন্য হোটেলটি বন্ধ আছে।
ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল গ্রুপ (আইএইচজি) বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে তাদের হোটেল ব্যাবসা পরিচালনা করছে। এ গ্রুপের টপ ব্র্যান্ড হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। বর্তমানে ৬০টি দেশে এই ব্র্যান্ডের ১৮০টি হোটেল পরিচালিত হচ্ছে। আইএইচজি'র অন্য ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্রাউন প্লাজা, হলিডে ইন, হলিডে ইন এক্সপ্রেস, ক্যান্ডেলউড সুইট, হোটেল ইনডিগো, কিমপটন হোটেল প্রভৃতি। সব মিলিয়ে এই গ্রুপের ছয় হাজার হোটেল রয়েছে সারা বিশ্বে।
নতুন সাজে কেমন হবে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা, সেবার মান কতোটা হবে আধুনিক ও যুগোপযোগী? এসব প্রশ্ন নিয়ে পর্যটনিয়া কথা বলে হোটেলটির মার্কেটিং ও বিজনেস প্রমোশন ডিরেক্টর সহিদুস সাদেকের সঙ্গে। তিনি বলেন, আইএইচজি'র চেইন ব্র্যান্ড হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। এই ব্র্যান্ডটির নির্দিস্ট একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে। বিশ্বের সর্বত্রই ওই স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখে তারা ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। তাই আইএইচজি'র চাহিদা অনুযায়ী ব্র্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখে হোটেলটি সাজানো হচ্ছে। এখন চলছে শেষ পর্যায়ের কাজ।
সহিদুস সাদেক জানান, পুরোনো ভবনের বাইরের কাঠামোটা ঠিক রেখে ভেতরের সবকিছু ঢেলে সাজানো হয়েছে। আগের নকশা অনুযায়ী রুমগুলো ছিল ২৬ বর্গ মিটারের। কিন্তু বর্তমানে সারা বিশ্বের পাঁচতারকা হোটেলগুলোর রুম হচ্ছে ৩৫-৪৫ বর্গমিটার পরিসরের। আগের রুমগুলো সেই তুলনায় বেশ ছোট হয়ে গিয়েছিল।ওগুলো ভেঙে ৪০-৪২ বর্গমিটারের করা হয়েছে। আগের হোটেল ভবনে কক্ষ ছিল ২৭২টি। পরিসর বাড়ানোর কারণে কক্ষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২৬টি।
বিজনেস প্রমোশন ডিরেক্টর জানান, আগে হোটেলটির বলরুম ছিল একদিকে, আর উইন্টার গার্ডেন নামে সবচেয়ে বড় হলরুমের অবস্থান ছিল আরেকদিকে। এখন দুটোকেই আনা হয়েছে একসঙ্গে। উইন্টার গার্ডেনের নাম পাল্টে রাখা হয়েছে রুপসী বাংলা গ্র্যান্ড বলরুম। সুইমিংপুলটি স্থানান্তর করে সাজানো হয়েছে নতুন করে। প্রকৃতির ছোঁয়া দেয়ার জন্য এটাকে নেয়া হয়েছে তিনতলায় যেখান থেকে রমনার পার্কের প্রাকৃতিক দৃশ্য নজরে আসবে সাঁতারুদের। পানি শোধনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। ক্লোরিনের ব্যবহার ত্বক ও চোখের জন্য ক্ষতিকর। সেই পদ্ধতি থেকে বের হয়ে প্রাকৃতিক উপদান ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে। জিমনেশিয়ামকে যুগোপযোগী করা হয়েছে। নতুন করে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক স্পা সেন্টার। বিশ্বের সেরা স্পা প্রতিষ্ঠান এটি পরিচালনা করবে। অডিও-ভিজুয়াল লাইটিং সুবিধাসহ পাবলিক এরিয়া, ব্যাংকুয়েট হল ও মিটিং রুমের ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছে। রন্ধনশালা ও লন্ড্রির সরঞ্জামাদি প্রতিস্থাপনসহ সংস্কার এবং মেকানিক্যাল-ইলেকট্রিক্যাল-প্লাম্বিং সিস্টেমের আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে কার পার্কিংয়ে স্বয়ংক্রিয় কিছু ব্যবস্থা যুক্ত করে সুষ্ঠু পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
হোটেলটিতে ফুড সার্ভিসে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, খাবারের স্বাদ বাড়ানোর পাশাপাশি সেটাকে স্বাস্থ্যকর করে তোলার জন্য রয়েছে নানা আয়োজন। উপমহাদেশের খাবারের মধ্যে সুপরিচিত জনপ্রিয় সবধরনের খাবারই এখানে পরিবেশন করা হবে। বিশেষভাবে স্টেক হাউজ ও সিফুড বার থাকবে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানের পেস্ট্রি ও কফিশপ তো থাকছেই। পৃথিবীর সব ভালো ব্র্যান্ডের কফিই পাওয়া যাবে সেখানে। মোটকথা পৃথিবীর অন্যসব প্রথমসারির পাঁচতারা হোটেলে যে ধরনের সেবা ও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তার সবই মিলবে ইন্টারকন্টিনেন্টালে। , এছাড়াও পাল্টানো হয়েছে হোটেলের প্রবেশ পথের স্থাপত্য।বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে অভ্যর্থনা কক্ষের কারুকাজ করা হয়েছে। হোটেলটির পুরোনো আসবাবপত্র পাল্টানো হয়েছে। দেশীয় ঐতিহ্যের ভিত্তিতে ডিজাইন করা নতুন আসবাবপত্র প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। পাঁচতারা হোটেলের আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ইন্টারকন্টিনেন্টালের সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন রুমগুলোর মধ্যে রয়েছে ডিলাক্স, ডিলাক্স টুইন, সুপার ডিলাক্স, লাক্সারী ডিলাক্স, এক্সিকিউটিভ স্যুইট, কিং স্যুইট, প্রিমিয়ার স্যুইট, বাঙ্গালি স্যুইট প্রভৃতি। এসব রুম এবং স্যুইটগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে যুক্ত করা হয়েছে সিটি ভিউ সুবিধা। হোটেলের অভ্যন্তরীণ সুবিধার মধ্যে রয়েছে মিনি বার, বার, লন্ড্রি, রেষ্টুরেন্ট, হল রুম, বল রুম, কনফারেন্স রুম, কেন্দ্রীয় শীতাতপ, ইনডোর গেমস, সুইমিং পুল, পার্লার, সেলুন, ব্যায়ামাগার এবং স্টিম বাথ, রুম সার্ভিস, স্যুভেনির শপ, শপিং কর্ণার, এটিএম বুথ, ফরেইন মানি এক্সচেঞ্জ, গিফট শপ, কার রেন্টাল, ফ্যাক্স, কপিয়ার, স্কুয়াশ কোর্ট, টেনিস কোর্ট, চব্বিশ ঘণ্টা রিসেপশন, হুইয়ারপুল, চিকিৎসা কেন্দ্র, বাণিজ্যিক অফিস, এয়ারপোর্ট ট্রিপ, নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা ও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা।
বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেডের (বিএসএল) সঙ্গে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল গ্রুপের (আইএইচজি) যে চুক্তি হয়েছে তার মেয়াদ ৩০ বছররের। সেই অনুযায়ী আগামী তিনদশক এটি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা নামেই পরিচালিত হবে। বিএসএল সূত্রে জানায়, ২০১৪ সালে সংস্কার কাজ শুরুর সময় ইন্টার কন্টিনেন্টাল ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চারুতা জানিয়েছিল ২৫ মাসের মধ্যে কাজ শেষ হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও চুক্তি অনুযায়ী পাঁচ তারকা এই হোটেলটির সংস্কার কাজ শেষ হয়নি। ইন্টারকন্টিনেন্টাল মনোনীত দুবাইভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আইএম গত বছরের আগস্ট মাসে প্রকল্প রেখে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। যার কারণে সংস্কার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করে ওই বছরের অক্টোবরের মধ্যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি। ওই সময়ে কাজ সম্পন্ন করতে না পারায় ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সংস্কার কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়। শুরুতে হোটেলের সংস্কার ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫২৭ কোটি ৫ লাখ টাকা, সময় বৃদ্ধির কারণে সংস্কার প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৭২০ কোটি টাকা।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকার জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্বে রয়েছেন ব্রিটিশ নাগরিক জেমস ম্যাকডোনাল্ড। তিনি জানালেন, দীর্ঘ মেয়াদি সংস্কারের পর এরই মধ্যে বিএসএল কর্তৃপক্ষ ভবনের মূল কাঠামো ও কক্ষবিন্যাস প্রয়োজনীয় পরীক্ষন, কমিশনিং এবং ব্যালেন্সিংয়ের জন্য হস্তান্তর প্রক্রিয়া শেষ করেছে। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে আগস্টের মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
জেমস ম্যাকডোনাল্ড বলেন, হোটেলটি নতুন করে সাজানোর জন্য পূর্ব নির্ধারিত সময় ঠিক থাকেনি। যার কারণে আমাদের পক্ষে তা বুঝে নেওয়া সম্ভব হয়নি। আসলে যেসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে হোটেলটির সংস্কার হয়েছে, দক্ষ জনবলের অভাবে তাতে লম্বা সময় লেগে গেছে। এখন এটি বুঝে নেওয়ার সময়ও ছোটখাট ত্রুটি-বিচ্যুতি চোখে পড়ছে। অবশ্যই আমরা তা এড়িয়ে যেতে পারি না। বিসিএলকে আমরা এগুলো ঠিকঠাক করতে বলেছি। এগুলো সুষ্টভাবে সম্পন্ন না হলে আইএইচজি'র সার্টিফিকেশন মিলবে না। এসব খুটিনাটি কাজ আর জনবল নিয়োগ জুন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি বলেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ হোটেলের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হবে আগামী সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে। তবে উদ্বোধনের পরও গ্রাহকের প্রত্যাশা আনুযায়ী অবকাঠামোর উন্নয়ন কার্যক্রম চলবে।
৩৫ বছর পর ফের পুরনো নামে 'হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা' শুরু করবে নবযাত্রা। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, পুরনো ঐতিহ্য ধরে রেখে নতুন সাজে নতুন আয়োজনে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল সাড়া ফেলতে পারবে আগের চাইতে বেশি।