জিডিপির প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি হলো যেভাবে

Post Image

করোনা বদলে দিয়েছে জীবন। গত মার্চ থেকে বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। এরপর এপ্রিল ও মে মাসে বাস, ট্রাক, ট্রেন, ব্যক্তিগত গাড়ি—সব ধরনের যান চলাচল প্রায় বন্ধ ছিল। একইভাবে ট্রলার-লঞ্চ চলাচলও বন্ধ ছিল। আকাশে ডানা মেলেনি বিমান। মানুষও প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে খুব একটা বের হননি। জুন মাসে সীমিত পরিসরে গাড়ি চলাচল শুরু হয়।

সব মিলিয়ে প্রায় তিন মাস অর্থাৎ অর্থবছরের চার ভাগের এক ভাগ সময় পরিবহন চলাচল বন্ধ থাকলেও দেশের অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান কমেনি। বরং বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের (২০১৯-২০) মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বাস, ট্রাক, ট্রেন—এসবের মূল্য সংযোজন আগের বছরের চেয়ে ৪ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা বেড়েছে। নৌযান চলাচলে বেড়েছে ২৪৬ কোটি টাকা। আর বিমান চলাচলে বেড়েছে ৫১ কোটি টাকা।

এবার আসি পর্যটনশিল্পে। সেখানেও একই দুর্দশা। সেই ২৬ মার্চ থেকে পর্যটন এলাকায় হোটেল-মোটেল বন্ধ রাখা হয়েছে। করোনার শুরুর পর কক্সবাজারসহ দেশের পর্যটন স্পটগুলো প্রায় পর্যটকশূন্য ছিল। এখনো পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। করোনার কারণে প্রথম তিন মাস তো রেস্তোরাঁর মালিকেরা মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন। প্রায় সব রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যায়। জুন মাস থেকে ধীরে কিছু রেস্তোরাঁ সীমিত পরিসরে খোলা হয়েছে। তবে বেচাকেনায় আগের মতো জমজমাট ভাব নেই। বিবিএসের হিসাবে, বছর শেষে হোটেল-রেস্তোরাঁর অবদান জিডিপিতে বেড়েছে ৫০৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি রুহুল আমিন গতকাল মিডিয়াকে বলেন, ‘করোনার প্রথম তিন মাস ৯৫ শতাংশ রেস্তোরাঁ বন্ধ ছিল। মানুষের চলাচল সীমিত থাকলে খাবারের ব্যবসা হয় না। তবে করোনার আগেও ব্যবসা তেমন একটা ছিল না।’

জিডিপিতে নির্মাণ খাতের অবদান প্রায় ৮ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরে নির্মাণ খাতের অবদান ৮৮ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। নির্মাণ খাতের সিংহভাগ আসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে। বিদায়ী অর্থবছরে এডিবি বাস্তবায়ন আশানুরূপ হয়নি। গত অর্থবছরে এডিপির টাকা খরচ আগেরবারের চেয়ে ৫ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা কমেছে। এমন নজির আগে কখনো দেখা যায়নি। করোনার কারণে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ দুই-তিন মাস বন্ধ ছিল। বছর শেষে এডিবি বাস্তবায়ন ৮০ শতাংশে নেমে আসে, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, বিদায়ী অর্থবছরে জিডিপিতে নির্মাণ খাতের মূল্য সংযোজন বেড়েছে ৭ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা।

করোনাকালে ফ্ল্যাট বিক্রি তেমন একটা হয়নি। আবার অফিস, বাসাভাড়াও অনেক ক্ষেত্রে কমানো হয়েছে। বাড়িওয়ালার ভাড়া কমিয়ে ভাড়াটে ধরে রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু বিবিএস বলছে, আবাসন খাতের অবদান বেড়েছে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।

করোনার কারণে এসব খাতের এমন দৈন্যদশার পরও জিডিপিতে অবদান বেড়েছে। এসব খাত প্রতিবছর জিডিপিতে এক-চতুর্থাংশ অবদান রাখে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই খাতগুলো ভালো চলেনি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এসব খাতের বাড়তি অবদানকে ধরেই জিডিপির সাময়িক হিসাব করে বলেছে, বিদায়ী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, জিডিপির হিসাব মিলছে না।

করোনার সময়ে উল্লিখিত খাতের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই বন্ধ ছিল, তাই এত প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা নয়। এত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে আগের তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) এসব খাতে অন্তত দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি হতে হবে। বিবিএসের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, আগের কয়েক বছরে এসব খাতে কখনোই দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি হয়নি। বিদায়ী অর্থবছরে অর্থনীতিতে এত চাঞ্চল্যও ছিল না।

বিবিএসের এক কর্মকর্তা মিডিয়াকে জানিয়েছেন, যানবাহন বন্ধ থাকলে কিংবা হোটেল রেস্তোরাঁ একদিন বা নির্দিষ্ট সময় বন্ধ থাকলে জিডিপির কী পরিমাণ ক্ষতি হয়—এমন কোনো সমীক্ষা বিবিএসের নেই। ফলে ক্ষয়ক্ষতি প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা সম্ভব নয়।

সাধারণত প্রথম ৮-৯ মাসের তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে বিবিএস ওই অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাব দেয়। ৮-৯ মাসের প্রবণতা ধরেই পুরো বছরের হিসাবটি করে থাকে। কিন্তু এবার করোনার কারণে শেষের তিন–চার মাসের অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহ অন্য বছরের মতো ছিল না। অর্থনীতি প্রায় স্থবির হয়ে গিয়েছিল।

শিল্পের প্রবৃদ্ধি অর্ধেকে নেমেছে
কৃষি, শিল্প ও সেবা—এই তিনটি খাত নিয়ে জিডিপি গণনা করা হয়। করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে শিল্প খাতে। এই খাতের প্রবৃদ্ধি অর্ধেকে নেমে গেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরে তা কমে ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ হয়েছে। এর কারণ—করোনাকালে বেশির ভাগ কলকারখানা বন্ধ ছিল, ফলে বছর শেষে শিল্প উৎপাদনের পরিমাণও কমেছে। আগের 

বছর যেখানে শিল্প উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশের বেশি। বিদায়ী অর্থবছরে তা নেমে গেছে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশে। অবশ্য করোনার আগেই শিল্প উৎপাদন খাতে প্রভাব পড়তে শুরু করে। কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমে গিয়েছিল।

শিল্প খাত সম্পর্কে বিবিএসের দেওয়া তথ্যের মধ্যেও অসংগতি আছে। শিল্প উৎপাদন মূলত নির্ভর করে রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ চাহিদার ওপর। বিবিএস বলছে, বড় ও মাঝারি শিল্প উৎপাদন খাতে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশ। আবার বিবিএস বলছে, স্থিরমূল্যে রপ্তানির পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকা কমেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বেচাকেনাও কমেছে বলে জানা গেছে। এর মানে, শিল্প উৎপাদনে বিবিএসের প্রবৃদ্ধির হিসাবটি প্রশ্নবিদ্ধ।

বিদায়ী অর্থবছরে কৃষি খাতেও প্রবৃদ্ধি কমেছে। এই খাতে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ থেকে কমে ৩ দশমিক ১১ শতাংশে নেমেছে। জিডিপিতে অর্ধেক অবদান সেবা খাতের, প্রায় ৫১ শতাংশ। এ খাতের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ থেকে কমে ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ হয়েছে।

দেশের অভ্যন্তরে কী পরিমাণ পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয়েছে—এর মূল্যমান দিয়েই জিডিপি গণনা করা হয়। এটিই জিডিপির আকার। এবার আসি গত অর্থবছরে দেশের অভ্যন্তরে কী পরিমাণ পণ্য উৎপাদন ও সেবা সৃষ্টি হয়েছে। স্থিরমূল্যে বিদায়ী অর্থবছরে ১১ লাখ ৬৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকার সমপরিমাণ পণ্য উৎপাদন ও সেবা সৃষ্টি হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে তা বেড়েছে ৫৮ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে চলতি মূল্যে বিদায়ী অর্থবছরে জিডিপির আকার ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা।

বেসরকারি বিনিয়োগ আটকে আছে
চার বছর ধরেই জিডিপির অনুপাতে ২৩ শতাংশের ঘরেই বেসরকারি বিনিয়োগ আটকে আছে। বিবিএসের হিসাবে, জিডিপির অনুপাতে সার্বিক বিনিয়োগ এখন ৩১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। তবে সরকারি বিনিয়োগ বেশ চাঙা। গত অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে সরকারি বিনিয়োগ ৮ দশমিক ১২ শতাংশ, যা যেকোনো সময়ের তুলনায় রেকর্ড। গত এক দশকে সরকারি বিনিয়োগ ৪ থেকে ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মূলত বর্তমান সরকার বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যা সরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে।

২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত চলতি মূল্যে ৮ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা বেসরকারি বিনিয়োগ। বাকিটা সরকারি বিনিয়োগ।

মাথাপিছু আয় ২ হাজার ডলার ছাড়িয়েছে
বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় এখন ২ হাজার ৬৪ ডলার। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ১ লাখ ৭৪ হাজার ৮৮৮ টাকা।

গত অর্থবছরে মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১ হাজার ৯০৯ ডলার। মাথাপিছু গড় আয় কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত আয় নয়। একটি দেশের বার্ষিক মোট আয়কে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথাপিছু আয়ের হিসাব করা হয়।